বাঙ্গালীর জন্য কোনটা বেশি চিন্তার দূর্ভিক্ষ নাকি করোনা ভাইরাস?
বর্তমানে আমরা এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে দূর্ভিক্ষতে মৃত্যু এবং করোনাতে মানুষের মৃত্যু এ দুইটা বিষয় নিয়ে পৃথক চিন্তা করার সময় এসেছে। মোটামুটি ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের পরবর্তী সময় থেকে ক্রমান্বয়ে দেশ সেই সাথে দেশের বাইরেরও অর্থনৈতক অগ্রযাত্রা ধিরে ধিরে উন্নতির একটা অবস্থায় পৌঁছানোর কারনে মানুষের দূর্ভিক্ষ সম্পর্কে তেমন একটা ধারনা নেই।
পৃথিবীতে বির্ধমীদের প্রতি করোনা আক্রমনের পর থেকে আমাদের দেশেও লকডাউন করার মধ্যমে সকল ব্যবসা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান, যাতায়াত ও গনপরিবহন সহ সবকিছু বন্ধ রাখায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায় সৃষ্ট এ পরিস্থিতিতে গড়ে প্রতিদিন ৩৩০০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রায় দেড় মাস ধরে এই ক্ষতির পরিমান ২০১৯ সালের বাজেটের পরিমাণের অর্ধেকের কাছে চলে গেছে। সরকার কর্তৃক লকডাউননীতির আরো কঠরোতা দৃষ্টে যেটা মনে হচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকটা বাজেটের খরচের সীমাও অতিক্রম করে যাবে।
ইতিমধ্যে অনেক মানুষ স্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছে, অনেক ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে, পথে বসে গেছে অনেক খেটে খাওয়া মানুষ। তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষনে চিন্তিত হচ্ছি অর্থনৈতিক এ বিপর্যয়ে আসন্ন দূর্ভিক্ষের ফলে যে ক্ষয় ক্ষতি হবে তা করোনার ফলে কাল্পনিক ভাবে সৃষ্ট ক্ষতির চাইতে বেশি না কম (!!!)
বিষয়টা বুঝতে তাই ইতিহাসের বই আবার খুলতে হচ্ছেঃ
চীনের মহাদুর্ভিক্ষ (১৯৫৯-১৯৬১): ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত চীনে সংঘটিত দুর্ভিক্ষটি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্মম ও ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। গবেষকদের হিসাবমতে এ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩ কোটি এবং ইতিহাসবিদ ফ্রানক ডিকোটারের মতে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। চীনের মহাদুর্ভিক্ষ সম্পর্কে জিন জিয়াং এর একটি সরকারি দলের সচিব ইয়ু দিহং বলেন,
“আমি এক গ্রামে গিয়ে ১০০ লাশ দেখি, তারপর অন্য গ্রামে অন্য ১০০ লাশ দেখেছি। কেউ তাদের দিকে মনোযোগ দেয়নি। লোকেরা বলে যে কুকুর লাশ খাচ্ছিল। কিন্তু তা সত্য না। কারন তার আগেই মানুষ কুকুর খেয়ে ফেলেছিল।”
চীনে ১৯০৭ সালের দূর্ভিক্ষ: ১৯৫৯ সালের আগে চীনের জনগণের আরো একবার করাল দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা হয় ১৯০৭ সালে। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ২য় ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। এ সময় প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ মানুষ খাদ্য অভাবে অনাহারে মারা যায়।
এ দুর্ভিক্ষের কারন হিসাবে দায়ী করা হয় সে সময়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যাকে। পূর্ব-মধ্য চীন সে সময়ে এক মারাত্মক ঝড় ও বন্যার সম্মুখীন হয়। এ সময় ফসলের প্রায় শতভাগ বন্যার কারনে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে নেমে আসে ভয়াবহ খাদ্য সংকট এবং দেখা যায় ইতিহাসের দ্বিতীয় করুণ দুর্ভিক্ষ।
রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ (১৯২১–১৯২২) : ১৯২১ সালের রাশিয়ার দুর্ভিক্ষের কারন ছিল হঠাৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও প্রতিকূল আবহাওয়া। এ সময় ৫০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। সে সময় খাবারের জন্য মানুষ অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ করতেও বাধ্য হয়েছিল। পোকামাকড়, কাদামাটি, গাছের পাতা, মৃত প্রাণী, এমনি মানুষের গোশত পর্যন্ত খেয়েছে অনেকে। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে নিজ সন্তানকে হত্যা করে পর্যন্ত গোশত খেয়েছে। অনেকে আবার কবর খুঁড়ে মৃত মানুষের গোশত খেয়েছে। মানুষ হত্যার পুলিশি রিপোর্ট থানায় অগ্রাহ্য করা হত সে সময়, কারন তখন মানুষ হত্যাকে বেঁচে থাকার একটি উপায় হিসেবে ধরে নেয়া হত।
ভিয়েতনামে দুর্ভিক্ষ (১৯৪৪–১৯৪৫) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের দখলে থাকাকালীন সময়ে ভিয়েতনাম এক নির্মম দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স ও জাপানের দখলদারিত্বকেই মূলত এ দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করা হয়। একদিকে জনগণ অনাহারে মরছে, অপরদিকে ফ্রান্স এবং জাপান পাওয়ার স্টেশনে জ্বালানীর জন্য ধান এবং গম ব্যবহার করে। ফ্রান্সের দখলে থাকাকালীন ভিয়েতনামে প্রশাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা হয় এবং জোরপূর্বক ফ্রান্স ভিয়েতনাম থেকে অর্থ নিয়ে যেতো। এ ছাড়া ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপকহারে ফসলের ক্ষতি হয়। এসব কারনে ভিয়েতনামে দুর্ভিক্ষ হয় এবং এ দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
এবার আসুন আমাদের উপমহাদেশ ও দেশের দিকে নজর দেয়া যাক,
পঞ্চাশের মন্বন্তর: ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তৎকালীন ভারতবর্ষে লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। এই মন্বন্তরে বাংলাজুড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যায় । ১৩৫০ বঙ্গাব্দে ( খ্রি. ১৯৪৩) এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হয়। এতে প্রদেশের প্রায় সাত লক্ষ পরিবারের অথবা ৩৮ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার লক্ষণীয় অবনতি ঘটে। এর কারণ হলো, তারা তাদের যাবতীয় সম্পত্তি তথা ভূমি, লাঙল, গবাদিপশু, গহনা, বাসন-কোসন, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এভাবে সাড়ে তিন লক্ষ পরিবার চরম দারিদ্রে নিপতিত হয়। এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় যে, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং এর ফলে সৃষ্ট মহামারিতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়। বিশেষ করে দুই বাংলায় দুর্ভিক্ষের করাল থাবা ছিল সবচেয়ে করুণ। ভারতবর্ষের তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা ও যুদ্ধে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ করায় এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ: স্বাধিনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সরকারী হিসেব অনুসারে ২৭,০০০ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসেবে অনুমানিক ১,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ জন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়। মোট মৃতের সংখ্যা, যদিও বিভিন্ন পরিসংখ্যানে আলাদা আলাদা এসেছে, এক গবেষক প্রায় ১৫ লাখকে গ্রহণযোগ্য আনুমানিক সংখ্যা হিসেবে ধরেছেন। এই সংখ্যায় দুর্ভিক্ষ পরবর্তী সংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত আছে। অনাহার একমাত্র কারণ ছিল না, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৃত্যুর কারণ ছিল দূর্ভিক্ষ পরবর্তী কলেরা, ম্যালেরিয়া এবং ডাইরিয়ার মত রোগ। বেশিরভাগ দুর্ভিক্ষের মতো, এই দুর্ভিক্ষেও অনাহারে দুর্বলতা, রোগ-সংবেদনশীল পরিস্থিতির কারণে দুর্ভিক্ষ পরবর্তী মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪,৫০,০০০ জন। দরিদ্র, শ্রমিক এবং ভূমিহীনরা বিশেষত ভয়াবহতার শিকার হন।
উপরোক্ত মাত্র কয়েকটা দূর্ভিক্ষের ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়,
১) সরকারী ভুল সিদ্ধান্তের কারনে হোক বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারনেই হোক দূর্ভিক্ষ হয়ে গেলে অসংখ্য মানুষের প্রাণ চলে যাবে।
২) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়ের জন্য ভেঙ্গে যাবে।
৩) দেশ অনেকগুন পিছিয়ে যাবে।
৪) সেই সাথে দূর্ভিক্ষ পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট হবে মহামারী, সেখানে আরো বিরাট সংখ্যক মানুষের প্রাণ ও সম্পদ ধ্বংস হবে।
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকান, তাদের হিসাবে করোনায় মৃত্যু সংখ্যা সবমিলিয়ে ১৭৭৪১৫ জন। আর বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী ১১০ জন। ৭০০ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে এ সংখ্যা খুব একটা বেশি না। অথচ হিটলার বাহীনি একাই ১৪ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছিলো অন্যদের কথা নাই বা বললাম। বিশ্ব স্বস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২৫ লক্ষ আক্রান্তের মধ্যে ৭ লক্ষ রিকভার করেছে এবং ১৭৭৪১৫ মাত্র মারা গেছে। রিকভারের সংখ্যাই বেশি। আর এই মৃত্যুহারের বেশিরভাগই অমুসলিম দেশে। তারা চুড়ান্ত সর্তকতা অবলম্বন করেও মৃত্যু কমাতে পারছে না। পেন্টাগন থেকে শুরু করে, গভীর সমুদ্রে থাকা যুদ্ধ জাহাজ শেষ পর্যন্ত মহাকাশেও হানা দিয়েছে করোনা। সর্তকতা, সামাজিক দূরত্ব কোনটাই কি কাজে এসেছে? অনেকে ঘর থেকেই বের হয়নি, হোম কোয়ারেন্টাই করছিলো কিন্তু সেই হোমই তাদের মৃত্যুর ঠিকানা হয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশের মত ঘনবসতি পূর্ণ একটা দেশে যেখানে বেশিরভাগ মানুষই সামাজিক দূরত্ব নামক এই বিধান মানে না। করোনার ভয়ে না শুধু পুলিশ বা আর্মি দেখলে তাদের লাঠির ভয়ে মাষ্ক পরিধান করে দেশের লোক, অথচ এখানেই মৃত্যু হার কম। বরং অন্য বছরের তুলনায় এখন সার্বিকভাবে মৃত্যুহারই কমে গেছে দেশে। শুধু তাই নয় এই দাবিকৃত ১০০ জনের মধ্যে সবাই করোনায় নয় বরং বিভিন্ন অসুস্থার কারনে মারা গেছে, সামজিক সহায়তা ও চিকিৎসা ব্যর্থতায় এদের করোনা বলে চালানো হচ্ছে। সকাল বেলা বাজারে যান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত মানুষদের দিকে তাকান, বি বাড়িয়ার কয়েকটা ঘটনার দিকে তাকান মানুষ জনের সামাজিক দূরত্বে নেই, যদি সামাজিক দূরত্ব ফ্যাক্ট হতো তাহলে বাংলাদেশ এতদিনে খালি হয়ে যেত। হার্ড ইমিউনিটির ডেভলপ হচ্ছে এদেশে এর একটা প্রভাব সৃস্ট হচ্ছে, ফলে এখানকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না হবেও না। মাঝখান থেকে তথাকথিত লকডাউন দিয়ে দেশর হচ্ছে পঙ্গু, দেশের দিকে ধেয়ে আসছে দূর্ভিক্ষ। ১০০ জন কাল্পনিক মৃত্যেুর চাইতে আসন্ন দূর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে ভিষণ ভায়ানক, মর্মান্তিক।
তাই সরকারের প্রতি আহ্বন, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখানও শেষ হয়ে যায় নাই। কল কারখানা খুলে দিন, মানুষের কাজে ফেরার সুযোগ দিন। অর্থনীতির চাকা ঘুরান। অনিশ্চিত মৃত্যুর ভয়ে মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন না।