হাবিব সালেহ।

ইসলামী শরিয়তের স্তম্ভ অস্বীকার ও রাসুল (সা.) এর অবমাননাকারী নাস্তিক মুরতাদদের ফাঁসির দাবিতে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে দুইহাজার তেরো সালের আজকের দিনে ঐতিহাসিক অবরোধের ডাক দেন আলেম উলামাদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।কোটি মুসমানদের হৃদয়ের মনি,বাংলার উলামায়ে কেরামের শ্রদ্ধাভাজন রাহবর,আমিরে হেফাজত,আল্লামা শাহ আহমদ শফি হাফিজাহুল্লাহ এর আহবানে দেশের প্রতিটি জেলা,থানা ও গ্রাম থেকে ঈমানী আন্দোলনে শরিক হতে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

আমরা সুনামগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রাম থেকে শতাধিক ইসলাম প্রিয় তৌহিদী জনতা ঈমানী চেতনা ও আগ্রহ নিয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করি।
সেদিনে আমাদের সৈয়দপুরের কাফেলার নেতৃত্ব দেন জামেয়া সৈয়দপুরের মোহতামীম শায়খ হাফিজ মাওলানা সৈয়দ ফখরুল ইসলাম সাহেব ও নাজিমে তালিমাত আমার বাবা শায়খ হাফিজ মাওলানা সৈয়দ ফুজায়েল আহমদ রহঃ আজ তিনি নেই!রাব্বে কারীম আপনাকে ভালোবাসুন,জান্নাত দান করুন আমিন।
চার মে দিনের আলোর শেষ প্রান্তে হযরতদ্বয়ের নেতৃত্বে রওনা দিয়ে রাতেই স্পটস্থল নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ মাদানিনগর মাদরাসায় পৌঁছি।
মাদানিনগর মাদরাসায় আমাদের অবস্থান কেন্দ্র।
এতো মানুষ,অর্ধ লক্ষের মতো।অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে মেহমানদারি করেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। এতো লোকের ইন্তেজাম দেখে খুবই অবাক হই।আল্লাহ তাদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।আজকের দিন পাঁচ মে সূর্য উঠতেই পা’য়ে হেঠে আরম্ভ হয় অবরোধ।চলছে পথ যাত্রাবাড়ী মুড়ে আমরা একত্র হই লক্ষাধিক ঈমান দ্বীপ্ত মুসলমান।নারায়ে তাকবির আল্লাহু আঁকবারের স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে রাজপথ,মনে হয় যেন নতুন এক বিপ্লব।মনে হলো আজই কায়েম হবে শরিয়ত।
দৃশ্যমান হলো এমাটিতে ইসলাম ছাড়া আর কিছু নেই,এদেশ শুধুই আলেম উলামাদের,মসজিদ মাদরাসা ও ইসলাম প্রেমিকের।ঠিক দুইটায় খবর আসলো শাপলা চত্বরে সবাই জমা হওয়ার জন্য।সমাবেশ হবে,আমরা রওনা দেই লাখো মানুষ পা’য়ে হেঠে শাপলা চত্বরের দিকে।শুনছি পা’য়ে হেঠে চার ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।গাড়ি নেই হাটা ছাড়া যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা নেই। আমরা চিন্তা করলাম,বিকল্প কোন পথের।অতঃপর আমরা ছোট একটি ট্রাক পেলাম,আমরা সিলেটী কয়েক ভাই মিলে ট্রাক রিজার্ভ করি।এদারা মহাসচিব বরকপুরী রহ.এর ছেলে,মাওলানা বুকায়ের আহমদ,মাওলানা আরশাদ নোমান,ও আমরা তিনজন হাফিজ মাওলানা সৈয়দ তাহসীন আহমদ,হাফিজ সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ও আমি অধম।সবাই ছোট ট্রাক নিয়ে শাপলাচত্বরের দিকে ছুটলাম।একটু সামনে যেতেই চোখে পড়লো সিলেটের হেফাজতের আমির হযরত গাছবাড়ি হুজুর হাফিজাহুল্লাহ পা’য়ে হেঠে ক্লান্ত হয়ে একটি দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন,আমরা হযরত কে আমাদের গাড়িতে রিসিভ করলাম,চললাম গন্তব্যপথে,রাস্তায় কোন গাড়ি না থাকলেও সারাটা রাস্তা তৌহিদী জনতার দৃশ্য এতোই ছিলো গাড়ি চলার কোন ফাঁক খুঁজে পাচ্ছে না।আমাদের গাড়িতে মাইক ছিলো ঘোষণা করা হলো সিলেটের আমির আসছেন,রাস্তা ক্লিয়ার করুন।স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাস্তা ক্লিয়ার করছেন,হযরতের সুবাদে আমরা শাপলাচত্বরের স্টেইজের একেবারেই নিকটে পৌছি।যদি হযরত না থাকতেন সমাবেশের কাছেই যাওয়া সম্ভব হতো না।শুরু হলো সমাবেশ কোটি জনতার সমাগম,একে একে ভাষণ দিচ্ছেন দেশের শীর্ষ বু্যোর্গানে দ্বীন,উলামায়ে কেরাম ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ।

সেদিনের সমাবেশের চিত্রপট ও বক্তব্যের গর্জনে অনুভব হলো বদর ওহুদ খন্দক হুদাইবিয়া ও বালাকোটের কথা!নেতৃবৃন্দের এক একটি ভাষণ আর হুংকার চেতনা ও প্রেরণা জাগানিয়া ছিলো।অনুভূতি হলো যেন খালিদ বিন ওয়ালিদ,মুহাম্মদ বিন কাসিম,
শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান ও হুসাইন আহমদ মাদানির নমুনার বৈপ্লবিক বুলেট হচ্ছে।চলছে সমাবেশ এমনি মুহুর্তে বিভিন্ন স্পটে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক ঈমানী চেতনা দ্বীপ্ত মুসলিম ভাইদের উপর নির্যাতন ও সরাসরি গুলি করে শহীদের পথের সূচনা হতে লাগলো,স্টেইজ মুখি হচ্ছে তরতাজা লাশ। কান্না আর অশ্রুকণা আরম্ভ হলো।চলছে সমাবেশ নির্ধারিত সময় নিকটবর্তী মাগরিব সন্নিকটে।মাইক পরিচালনা থেকে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব সাহেব ঘোষণা করেন এখন সিলেটের অন্যতম বুযোর্গ ওলি ইবনুল ওলি আল্লামা রশিদুর রাহমান ফারুক শায়খে বর্ণভীর বক্তব্য ও মুনাজাতে হবে।ভাবলাম এরপর শেষ হবে সমাবেশ কিন্তু…………ছয় মে শহীদ দিবস।
শাপলা চত্বরের অবরোধের দিন শেষ মুহুর্তে,আমিরে হেফাজত আল্লামা আহমদ শফি হাফিজাহুল্লাহ আসবেন মঞ্চে লক্ষ কোটি জনতা অপেক্ষমাণ,কিন্ত কিছু দালালদের কারণে সমাবেশে আসতে বাধাগ্রস্ত হন।এজন্যই রাতের অবস্থান টা আমিরের অনুমতি ব্যতীত হয়েছিল। তাই অনেকেই সমাবেশ স্থল ত্যাগ করতে লাগলেন। আমরা ছোট ছিলাম আমাদের কাফেলার পক্ষ থেকে বারবার ফোন যাচ্ছে,শাপলাচত্বর থেকে আমাদের স্পট স্থলে আসার জন্য।আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছুটলাম গন্তব্যের দিকে,আমরা তিনজন মাগরিবের পর শাপলা থেকে নারায়ণগঞ্জ প্রায় ছয় থেকে সাত ঘন্টা হেটে এসেছি।এদিকে রাত ঘন হচ্ছে আধারের বুকে ইতিহাস সূচিত হচ্ছে। যত আধার হচ্ছে শাপলা চত্বর এক কালো ইতিহাসের দিকে যাচ্ছে। আরম্ভ হলো স্বৈরাচার শাসকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া বুলেটের মুহুর্মুহু বিকট শব্দ,বুলেটে যেন কেঁপে উঠে আকাশ,নেমেছে ভয়াল ভয়ানক চরম লোমহর্ষক নির্যাতন।তাহাজ্জুদ ও নামাজরত,মুসল্লিদের তাজা বুকে বুলেটের পর বুলেটের আঘাত,ক্ষতবিক্ষত প্রাণ!যেন অবর্ণনীয় অকল্পনীয় কালো ইতিহাস।কতজন শহীদ হয়েছে তার কোন সীমা নেই।শহীদের লাল রক্তে লাল সবুজে নতুন ইতিহাস যোগ নিলো।ঘটলো এক কারবালা সংযুক্ত হলো বালাকোট।হৃদয়ে অনুভূতি সৃষ্টি হলো যে আগামীকাল মনে হয় আর সূর্য উঠবে না!ইসলামের আলো নিভে যাবে!নিস্তব্ধ হয়ে যাবে সব।মাদরাসা মসজিদ আর থাকবে না।আলেম উলামাদের ক্ষমতা শেষ।মাথা উঁচু করার হিম্মত হারিয়ে যাবে!দেশ টা কেমন যেন অন্ধকারে ডুবে গেল! কিন্তু না,ইসলাম জিন্দা হতা হায় হর কারবালা কে বা’দ।

দ্বীন ও ইসলামের জন্য রাসুল (সাঃ) এর দান্দান
মুবারক শহীদ করেছেন,ইসলাম শেষ হয়নি।
আমিরে হামজার লাশ টাকে টুকরো টুকরো করে
দেওয়া হয়েছে,ইসলাম শেষ হয়নি।সুমাইয়া রাঃকে লোমহর্ষক নির্যাতন করা হয়েছে,ইসলাম শেষ হয়নি,
সাহাবায়ে কেরামদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, ইসলাম শেষ হয়নি।যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে ইসলাম শেষ হয়নি।তবেইন তবে তাবেইন আইম্মায়ে মুজতাহিদিন ইসলামের জন্য নিজের জান কে বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলাম শেষ হয়নি। আকাবির উলামায়ে কেরাম ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন,
বালাকোট,রেশমি রুমাল,মালটায় কারাবরণ,
ইংরেজদের চরম নির্যাতনে ইসলাম শেষ হয়নি।
শাপলা চত্বরে ইসলামের জন্য জান উৎসর্গিত শহীদের কারণে ইসলাম শেষ হয়নি।বরং শহীদের ছিঁড়ি বেয়ে এদেশে একদিন ইসলামের বিজয় হবে।লাল সবুজের বুকে কালেমার নিশান পতপত করে উড়বে।শহীদের চেতনা আর তামান্না বুকে লালন করে এদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম হবেই হবে।ইনশাআল্লাহ।

লেখক: হাফিজ মাওলানা সৈয়দ হাবিব সালেহ।
সৈয়দপুর,জগন্নাথপুর,সুনামগঞ্জ।