বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক জনপ্রিয় যুগোপযোগী, স্বেচ্ছাসেবী যুব আন্দোলন স্কাউটিং। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হলো শিশু-কিশোর ও যুবকদের শারীরিক-মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক আন্দোলনে গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে সৎ, চরিত্রবান ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। বিপিএটিসি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছয় শিক্ষার্থী স্কাউটিং করে এ বছর অর্জন করেছে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। এরা হলো নিশান নাসিম রুদ্র, সাজিয়া তারান্নুম ইতাবা, জান্নাতুল ফেরদৌস রুবা, সাব্বি রেজওয়ানা তিথী, ফাতেমা খাতুন ও ফজর আদনান।

বিশ্বায়নের এই যুগে পড়াশোনা ঠিক রেখে পারিবারিক বাধা ডিঙ্গিয়ে স্কাউটিংয়ে পথচলাটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এ পুরস্কারের পেছনে রয়েছে তাদের কঠোর পরিশ্রমের গল্প। সাধারণ সদস্য হয়ে অন্তত নয় মাস কাজ করে স্টান্ডার্ড অধিকার অর্জন করতে হয়, তারপর এক বছর কাজ করে অর্জিত হয় প্রগ্রেস, আরও বছরখানেক যুক্ত থেকে করতে হয় সার্ভিস। তারপর চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রেসিডেন্সি অ্যাওয়ার্ড। চারটি পর্ব (সদস্য, স্টান্ডার্ড, প্রগ্রেস ও সার্ভিস) পার করে অর্জিত হয় এই সর্বোচ্চ পদক প্রেসিডেন্সি অ্যাওয়ার্ড। নিজ প্রতিষ্ঠানে, উপজেলায়, জেলায়, বিভাগে এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে উত্তীর্ণ হলেই রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। কঠোর পরিশ্রম আর মেধা ব্যয় করেই দেশের আরও অনেকের মতো এই পদক অর্জন করেছে তারা। আসুন এই ছয়জনের আরও কিছু গুণের কথা জেনে নিই।

সাব্বি রেজওয়ানা তিথী

সাব্বি রেজওয়ানা তিথী
ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় দারুণ দক্ষ তিথী। বিপিএটিসি স্কুল অ্যান্ড কলেজ আর্ট ক্লাব ‘সুকাজ’ এ ছবি আঁকা শিখেছে তিন বছর। প্রতিটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। দারুণ সব ছবি আঁকে। ছবি অঙ্কনের অনেক পুরস্কার তার ঘরে। অভিনয়েও তিথী দক্ষ। একক ও দলীয় অভিনয়ে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের পুরস্কার রয়েছে তার। জাতীয় স্কাউট সমাবেশে তাঁবু জলসায় একটি বড় অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেছে তিথী। বই পড়তে পছন্দ করে। হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার প্রিয় লেখক। হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ তার প্রিয় বই। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে তার ভালো লাগে। তিথী একটি সামাজিক সংগঠনে যুক্ত আছে। সে খুব ভালো ফলাফল করেছে এসএসসিতে। জিপিএ-৫ পেয়ে তিথী এখন বিপিএটিসি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তিথী তারুণ্যের শক্তি দিয়ে মানবতার জয় দেখতে চায়।

নিশান নাসিম রুদ্র

নিশান নাসিম রুদ্র
পড়ার অবসরে রুদ্র প্রায়ই গিটার নিয়ে বসে। নিজে গান লিখে নিজেই সুর বসায়। নিজের লেখা গান গেয়ে ভালোই নাম করেছে বন্ধুমহলে। বই পড়তেও পছন্দ করে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ঘটনা, স্থান সম্পর্কে পড়তে রুদ্রর ভালো লাগে। ভালো লাগে ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতে। কম্পিউটারের টুকিটাকি, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ। মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভ জবস, বিল গেটসের জীবনী তার মুখস্থ। রুদ্র এখন দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছে। অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তিপ্রাপ্ত রুদ্র ভবিষ্যতে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে বুয়েটে পড়াশোনা করে সেখানেই শিক্ষকতা করতে চায়। স্কাউট ড্রেস পরে যেকোনো দায়িত্ব পালন করতে তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। সব শিশু যেন পড়াশোনা করতে পারে, সে জন্য কাজ করতে চায়। ভবিষ্যতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করবে, এই তার প্রতিজ্ঞা।

ফজর আদনান

ফজর আদনান
কঠোর পরিশ্রম করতে পারে আদনান। সেবামূলক কাজ করতে পছন্দ করে। তার নেতৃত্বে স্কাউট টিম ট্রাফিক সপ্তাহে পুলিশকে সহায়তা করেছিল। ফজর আদনান ভালো সাঁতার জানে। উপজেলা পর্যায়ে সেরা সাঁতারুর পুরস্কার আছে তার। পাশাপাশি বিজ্ঞানের বই পড়তে পছন্দ করে। কোরআন তিলাওয়াতে রয়েছে তার বেশ দক্ষতা। খেলাধুলায় আদনান বেশ নামকরা। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল যেকোনো প্রতিযোগিতায় আদনান ছাড়া টিম শক্তিশালী হয় না। পড়াশোনায়ও আদনান বেশ ভালো। জেএসসি তে জিপিএ-৫ এবং ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়ে এখন সে একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে সে এখন সামাজিক সংগঠন ‘নীলপদ্ম’-এর একজন সক্রিয় সদস্য। ফজর আদনান দরিদ্র শিশুদের সমস্যা এবং ভিক্ষুক সমস্যা সমাধানে কাজ করতে চায়।

জান্নাতুল ফেরদৌস রুবা

জান্নাতুল ফেরদৌস রুবা
ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকায় তার দুর্বলতা। জলরঙে ছবি আঁকতে তার ভালো লাগে। বিপিএটিসি স্কুল অ্যান্ড কলেজ আর্ট ক্লাব সুকাজে ছবি আঁকা শিখেছে দুই বছর। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়েছে অনেক। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় সব সময়। কবিতা আবৃত্তিতে সুনাম রয়েছে। রুবা খেলাধুলা করে নিয়মিত। খেলাধুলাতেও তার অনেক পুরস্কার রয়েছে। ক্র্যাফট পারে ভালো। কাগজ ও ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে সুন্দর সব কারুশিল্প তৈরি করেন। স্কাউটিংয়ের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন করে। গরিব ও দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করতে চায়। বর্তমানে সে বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যতে সে ভালো ফল করে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চায়।

ফাতেমা খাতুন

ফাতেমা খাতুন
ফাতেমা প্রচুর বই পড়ে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ সব বিষয়ে তার বিপুল আগ্রহ। হয়তো এ কারণে নিজেও বেশ ভালো কবিতা লিখতে পারে। ছবি আঁকতে পারে ভালো। পত্রিকা পড়ে নিয়মিত। দেশ-বিদেশের সব খবরাখবর তার রাখা চাই-ই চাই। খেলাধুলা করে নিয়মিত। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সব বিষয়েই প্রথম স্থানের পুরস্কার যায় তার ঘরে। বিতর্ক ও আবৃত্তি ভালো করে ফাতেমা। সব মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে চায়। যুক্ত আছে একটি সামাজিক সংগঠনে। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া বহু প্রতিভার অধিকারী ফাতেমা ভবিষ্যতে বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষা কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করতে চায়।

সাজিয়া তারানুম ইতাবা

সাজিয়া তারানুম ইতাবা
ইতাবার খুব প্রিয় স্কাউট। বড় বড় অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলার জন্য যখন স্কাউটরা দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন সেই দৃশ্য দেখতে তার অনেক ভালো লাগে। নিজের জীবনে শৃঙ্খলা, সেবা আর শান্তি আনতেই স্কাউটিংয়ে যোগ দেয় ইতাবা। বই পড়া, ছবি আঁকা ও গান শুনতে তার ভালো লাগে। নাচও করে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সবচেয়ে ভালো লাগে তার মানবতার সেবা করতে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনায় আহত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। সর্বাত্মক সহায়তা করে। বিপিএটিসি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইতাবা ভবিষ্যতে ব্যারিস্টার হতে চায়।

*হিমেল হোসেন হিমু, সংগঠক, নীলপদ্ম, সাভার, ঢাকা। প্রথম আলোর সৌজন্যেঃ