মুহাম্মদ মাহদী হাসান ।।

আমার এই ক্ষুদ্র বয়সে অনেক আল্লাহওয়ালা বাযূর্গ, পীরে কামেল, পরহেযগার বিপ্লবী রাহবার দেখেছি। কিন্তু আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (হাফি.)এর মত নেককার, পরহেযগার ও নীতিতে অবিচল আদর্শবান বিপ্লবী, রাহবারে বর হক্ব, আপোষহীন নেতা আমি আদৌ দেখিনি। যাঁর নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও আপোষহীন গুণের কারণে দেশের কোটি কোটি তৌহিদী জনতা তাঁর ডাকে সাড়া দিতে সর্বদা প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন।

গত কিছু দিন আগে জামালপুর থেকে এক বড় ভাই ফোন করে ছিলেন। তিনি আবার আমাকে ফেসবুকে ফলো করেন। সে সুবাদে একদিন আমার কন্টাক্ট নম্বর নিয়ে ফোন দিলেন। এক পর্যায়ে বললেন, শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (হাফি.)এর পক্ষ হতে যদি কখনো ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ডাক আসে, তাহলে আমি সবার আগে লাব্বাইক বলে সাড়া দিব এবং ইসলাম ও হক্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত আছি, ইনশাল্লাহ।

এমন লোক শুধু তিনি একা নন, লাখো মানুষ রয়েছেন যাঁরা আল্লামা কাসেমী (হাফি.)এর আপোষহীন নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে সর্বদাই প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন।

বর্তমানে যখন করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও অঘোষিত লকডাউন পরিস্থিতি চলছে, প্রায় সকল মানুষ ঘরবন্দি, আপোষহীন এই রাহবার তখন নিজের হাতে গড়া সুবিখ্যাত ইলমী মার্কাজ “জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা” মাদরাসায় নিজ কক্ষে বসে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত এবং তাফসীর, হাদীস, ইতিহাস, বাযূর্গানে কেরামের জীবনী মুতালা’আয় দিন-রাত নিমগ্ন থেকে সময় পার করছেন, আর নামাযের সময় মসজিদে গিয়ে নামায আদায় ও অন্যান্য নফল ইবাদত-বন্দগীতে মশগুল থাকছেন।

বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে এই মহান বুযূর্গের দিনগুলো যেভাবে কাটে, সামনে থেকে দেখার আল্লাহ পাক সুযোগ করে দিয়েছেন। যেমন প্রতিদিন তিনি ফজর নামাযের প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা আগে বিছানা ত্যাগ করে অজু করে তাহাজ্জুদ আদায় করে জায়নামাযে বসেই তসবিহ হাতে আল্লাহর যিকিরে নিমগ্ন হয়ে যান। অত:পর ফজরের নামাযের আযান হলে দুই রাকা’ত সুন্নাত আদায় করে মসজিদে গমন করেন। ফজরের ফরয নামায আদায় শেষে চলে আসেন নিজ কামরায়। জায়নামাযে বসে প্রতিদিন মহান আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন থেকে এক পারা তিলাওয়াত করেন এবং সাপ্তাহিক প্রতিদিনকার জন্য নির্ধারণ করা হিজবুল আ’জমের অংশটুকু পাঠ করেন এবং দৈনন্দিন মা’মুলাতও শেষ করেন। এসব আমল শেষ করতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।

অত:পর সকালের নাস্তা এবং ঔষধ খেয়ে এক-দেড় ঘণ্টা বিশ্রাম নেন। সকাল নয়টা সাড়ে নয়টার সময় ঘুম থেকে উঠে গোসল করে কিতাব নিয়ে মুতালা’আয় বসে যান এবং একনাগাড়ে যোহরের আযান পর্যন্ত পবিত্র কুরআনের তাফসীর, হাদীসের উচ্চতর ব্যাখ্যাগ্রন্থ, বুযূর্গানে কেরামের জীবনী এবং অন্যান গবেষণামূলক ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কিতাব মুতালায়া করেন। এরপর যোহর নামাযের জামাআতের সময় হলে ফরযের আগের চার রাকআত সুন্নাত আদায় করে মসজিদে গমন করেন এবং জামাআতে ফরয, তারপর সুন্নাত-নফল আদায় শেষে  মসজিদে বসেই নির্ধারিত মা’মুলাত শেষ করে নিজ কামরায় ফিরে আসেন। তারপর দুপুরের খাবার গ্রহণ করে অল্প সময় সুন্নাত কায়লুলাহ করে পুনরায় কিতাব মুতালাআয় বসে যান। এভাবে প্রায় আসর পর্যন্ত কিতাব মুতলাআয় কাটিয়ে দেন।

তারপর আসরের আযান হলে অযু করে মসজিদে গমন করেন এবং জামাত শেষে নির্ধারিত মা’মুলাত শেষ করে জামিয়ার অফিস কক্ষে বসে দৈনিক পত্রিকা পড়েন। এ সময়ে সাক্ষাৎপ্রার্থী বিভিন্ন উলামায়ে কেরাম এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদেরকে সময় দেন। প্রসঙ্গ ওঠলে তাঁদের সাথে দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। হালকা নাস্তা ও চা গ্রহণ করেন।

অতঃপর মাগরিবের নামাযের সময় হলে মসজিদে গমন করেন। জামাত শেষে আওয়াবীন আদায় ও দৈনন্দিন মা’মুলাত শেষ করে নিজ কমরায় ফিরে এসে আবারও কিতাব মুতালা’আ শুরু করেন এবং ইশার আযান পর্যন্ত মুতালাআয় সময় কাটান। ইশার জামাআতর ৫ মিনিট আগে মসজিদে গমন করেন। জামাত, সুন্নাত ও নফল আদায় শেষে দৈনন্দিনের নির্ধারিত মা’মুলাত শেষ করে রাতের খাবার ও ঔষধ সেবন করে আবারও শুরু করেন কিতাব মুতালা’আ। প্রায় রাত ১২টা-১টার পর্যন্ত কিতাব ‍মুতালাআয় নিমগ্ন থেকে তারপর বিশ্রামে যান।

বর্তমান করোনা প্রাদুর্ভাবের অঘোষিত লকডাউন পরিস্থিতিতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের সময় ছাড়া পুরো সময়টা এভাবেই নামায-কালাম ও কিতাব মুতালাআ, গবেষণা ও পড়াশোনাতেই কাটাচ্ছেন এই মহান বুযূর্গ ব্যক্তিত্ব।

আসলে হযরতের কাছ থেকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় হলো, মূল্যবান সময়গুলো বেহুদা কথাবার্তা ও খোশগল্পে একটুও অপচয় না করা এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে পড়াশোনা ও গবেষণার মাধ্যমে সময়কে কাজে লাগানো।

হযরত সব সময় বলেন, বেটারা আমাদের সবার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ের একটি সেকেন্ডও যেন বিনষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সেও হযরত যেভাবে ধ্যান-খেয়ালের সাথে মুতালাআ-গবেষণা করেন, সময়ের গুরুত্ব দেন, লক্ষ্যহীন কথাবার্তায় একটুও সময়ের অপচয় করেন না, এসব দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। আমরা তরুণ-যুবারাও হযরতের মতো ধৈর্য ও একাগ্রতার কাছে হার মেনে যাই। অনেক সময় বিমুগ্ধ হয়ে ভাবি, এত ধৈর্য হযরতের কী করে হয়, কীভাবে পারেন এত পরিশ্রম করতে, একাগ্রতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিতাব মুতালাআয় কাটিয়ে দিতে! বাস্তবিকই বিস্ময়কর!!

মহান পরওয়াদিগার আল্লাহ’র দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, তিনি যেন দয়াপরবশ হয়ে এই মহান বাযূর্গকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘ হায়াতে তাইয়্যেবাহ দান করেন এবং তাঁর হাত দিয়েই এই দেশে ইসলামী হুকুমাত ও ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। সুপ্রিয় পাঠকদের কাছেও হযরতের সুস্থতা ও দীর্ঘ হায়াতের জন্য বিশেষ দোয়া প্রার্থনা করছি।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, গুলশান, ঢাকা।
সহ-অর্থ সম্পাদক, ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর।