আশা করি আল্লাহ রহমতের চাদর জড়িয়ে জান্নাতি মোহনায় বিচরণ করছেন। রহমতের ফেরেশতাদের সাথে চির শান্তির খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন। আপনি রসালো গল্পে বড় পাকা ছিলেন এখন হয়তো তা আরো বেড়ে গেছে। আপনার মায়াবী হাসি এখনো চোখের কিনারায় আনন্দের ঢেউ তুলে।আর কোরআন তেলাওয়াতের কথা কী বলবো ? দিলে যখন অস্থিরতা তৈরি হয় তখন আপনার তেলাওয়াত শুনে প্রশান্তির ঘুমে শরীর এলিয়ে দেই।
আপনার দুঃসাহসের চিত্রগুলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকে হার মানায়। আপনার সাহস দেখেছি বারবার। কিন্তু সেদিনের দৃশ্য ভুলতে পারিনি নাস্তিক ব্লগারদের বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে কুৎসা ও বাজে মন্তব্যে আপনি যতটা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন বাপরে বাপ যদি শয়তানগুলোকে সামনে পেতেন কী যে করতেন আল্লাহ মালুম।
আর রাজপথ যেন আপনার প্রিয় কোন প্রাসাদের বেলকনি । আন্দোলন সংগ্রাম আপনার রক্তের উত্তরাধিকার। আপনি ফখরে বাঙাল তাজুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহির মাটির সন্তান, সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুরের সান্নিধ্যে ধন্য প্রশস্ত বুকের বীর সেনানী, উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহির হাতে তিলে তিলে গড়া সিপাহসালার । আপনার সাহস থাকবে না তাহলে কার থাকবে। বাবরি মসজিদ রক্ষার লংমার্চ, তাসলিমা নাসরিনের কুরআন বিদ্বেষের প্রতিবাদ, এনজিও দের অপকর্মের বিরোধীতা, নারী নীতির নামে শরীয়ত বিরোধী পরিকল্পনা, ফতোয়া রক্ষার আন্দোলন, সত্য পথের আহ্বানে সাড়া দিতে কখনো পিছপা হননি, আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ঢাকা ও মফস্বল
জেলার কর্মসূচিতে সবস্থানেই শাইখুল হাদিসের ডানে বামে পিছনে আপনার ভূমিকা স্মরণীয়।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে রাজপথে প্রথম গণ আন্দোলনের সূচনা হয় ২০০৫ইং পল্টনে জাতীয় ছাত্র কনভেনশনের মাধ্যমে।এগারো সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির আমি ছিলাম প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। অর্ধ লক্ষাধিক ছাত্রদের উপস্থিতিতে ১৫এপ্রিল পল্টনের জাতীয় ছাত্র কনভেনশনকে সফল করার ক্ষেত্রে আপনার শারীরিক, অর্থনৈতিক অবদান আমার স্বচক্ষে দেখা। আপনি আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খেলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের ক্লান্তিহীন আন্দোলনে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। যে কারণে তৃণমূল থেকে সংগ্ৰামী জীবনের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন।
আপনার হাতের ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে অনেক মসজিদ ও মাদ্রাসা। শংকরদাহ মিসবাহুল উলুম মসজিদ ও মাদ্রাসা এবং ঐতিহ্যবাহী জামিয়া রাহমানিয়া বেড়তলা মাদরাসা ও মসজিদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া পরিচালনা করেছেন জগদীশপুর তেমনিয়া মাদ্রাসা সহ বেশকিছু মসজিদ ও মাদ্রাসা যার অবদান অনস্বীকার্য।
প্রিয় আনসারী, আপনি কত এতিমদের আশ্রম ছিলেন সে হিসেব খুঁজে বের করা বড়ই দুষ্কর।কত আলেমের অভিভাবক ছিলেন আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবেনা। আপনার সুপরামর্শে কত কঠিন কাজগুলো সহজেই সমাধান হয়ে যেত তার ইয়ত্তা নেই।
আপনি ১৯৯৬ইং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও ইসলামী ঐক্যজোট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আপনার প্রিয় জন্মভূমি বি,বাড়ীয়া -১ নাসিরনগর আসনে নির্বাচন করেছেন তখন আমি বালক তবু আপনার মিছিল মিটিং এ দৌড়ঝাঁপ করেছি আপনার সে সময়ের অমায়িক ব্যবহার এখনো স্মৃতির এলবামকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে।
প্রিয় আনসারী হুজুর, আমার বিশ্বাস আপনার সুন্নতী আচরণ ও ব্যবহারে আপনি দেশ বিদেশের মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন দীর্ঘ কাল। আপনি যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন ও আপনি আগের আনসারী ছিলেন। যখন স্বভাবগত মানুষের জীবন যাপনে পরিবর্তন আসে। অহংকার, দাম্ভিকতা কখনো আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আপনি যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন( আমাদের গ্ৰামে এখনো আগের মতই মূল সড়ক থেকে দুই কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। )সেখানে রাত দুই আড়াইটার সময় কুয়াশায় সিক্ত হয়ে প্রচন্ড শীতে পায়ে হেঁটে আমাদের আয়োজিত মাহফিলে উপস্থিত হয়েছিলেন। মাহফিলে মঞ্চে বসে আমার প্রতি আপনার স্নেহের উক্তিটি আজো অন্তরে লিখে রেখেছি, আপনি বলেছিলেন”আমিতো আগের আনসারী নেই এখন চৌদ্দ ঘন্টা বসে থাকি আন্তর্জাতিক দামি এয়ার লাইন্সে, চরম ব্যস্ততা তারপরও স্নেহের মুজাম্মিলের আবদার ফেলতে পারিনি।যে কারণে কষ্ট করে ও গভীর রাতে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারাও ধৈর্য সহকারে বসে আছেন আমার জন্য তাই আপনাদের ভালোবাসায় আমি যে কোন কষ্ট করতে রাজি।”
প্রিয় আনসারী, উলামায়ে কেরামের প্রতি আপনার দরদ ভালোবাসা ছিল উপমাহীন।
নানাবিধ সমস্যা ও অসুস্থতার সময়ে কোন আলেমের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আপনার দানের হাত ছিলো এত প্রলম্বিত আমি ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে মুফতি শহিদুল ইসলাম এমপি ছাড়া আর কাউকে দেখিনি।
ওয়াজের ময়দানে আপনার তুলনা আপনি।
মনকাড়া সুর, বাচনভঙ্গির আকর্ষণ, ঘটনার শৈল্পিক ধারা বিন্যাস, পয়েন্টে হিট, যথাসাধ্য রেফারেন্স উল্লেখ, শিক্ষণীয় কথা, কুরআন হাদীসের সারমর্ম ব্যাখ্যা,আকাবের আসলাফের স্মৃতি চারণ,এক কথায় বহুমুখী জ্ঞানের অপূর্ব সম্মেলন ছিল আপনার বয়ান বক্তৃতায়।
মাহফিল শেষে যাতায়াত খরচ বা হাদিয়া প্রসঙ্গে কী বলবো? আপনি বাংলাদেশের সর্বজন স্বীকৃত মডেল। কেউ এ কথা বলতে পারবে না মাহফিলের হাদিয়া নিয়ে আপনার সাথে দরকষাকষি ও বিন্দুমাত্র মন মালিন্য হয়েছে।দুই বছর আগের ঘটনা গাজীপুর এক মাদ্রাসার মাহফিলে আমি সফরসঙ্গী ছিলাম আপনি বয়ান করে গাড়িতে আমি একটু আড়ালে। কর্তৃপক্ষ অফিস থেকে আসতে রাস্তার ভিন্নতায় ৫/১০মিনিট বিলম্ব। আপনি ড্রাইভারের প্রতি বিরক্ত মুজাম্মিল কোথায়? ইতিমধ্যেই আমি উপস্থিত। গাড়ীতে উঠার পর জিগ্গেস করলেন বিলম্বের কারণ বললাম হাদিয়া নিয়ে আসলাম। আপনি অনেক ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন আনসারীর রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলছো। আনসারী টাকার জন্য বিলম্ব করে না এবং কোন টাকা গুনে নেয় না। আল্লাহর ওয়াস্তে যে যা পারে দিবে না পারলে না দিবে। এ বিষয়ে কোনো মান- অভিমান নেই।বাস্তবে তিনি সারা জীবন এমনই ছিলেন। ইতিহাস এমনো অনেক আছে মাহফিল শেষে কোন কোন মাদ্রাসায় টাকা দিয়ে আসতেন।
প্রিয় আনসারী, আপনি এমন মহান ব্যক্তি সারা জীবনের উপার্জন ও অর্জনকে বেড়তলা মাদ্রাসার পিছনে ব্যয় করেছেন।আজ মাদ্রাসাটিতে হাজার হাজার ছাত্র কুরআন হাদীস শিখে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত। আপনি প্রাণের প্রতিষ্ঠানে চির নিদ্রায় শায়িত। পরিশেষে হুজুর বিশ্ব ব্যাপী করোনা মহামারীর আঘাতে বড় বড় উন্নত রাষ্ট্রগুলো দিশেহারা এবং লকডাউনে আবদ্ধ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ও সে মহামারীর করাল গ্ৰাসে আক্রান্ত। সারা দেশে লকডাউনের নির্দেশ জারি।আজরাইল আলাইহি সালাম এমন বিধিনিষেধের সময় এসে আপনাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে গেল শুক্রবার সন্ধ্যার আগে। আপনি কত দোয়া করেছেন এই দিনে মৃত্যুর জন্য। আল্লাহ তাআলা আপনার দোয়া কবুল করেছেন।
পর দিন সকাল দশটায় জানাজা আপনার মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত হলো । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লকডাউনের তালা ভেঙে লক্ষাধিক
আলেম উলামা ভক্ত ছাত্র সাধারণ মুসল্লিরা জানাজায় অংশগ্ৰহণ করলো। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হলো কী না এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা সর্বত্র। এককথায় বলা যায় টক অফ দা কান্ট্রি। আপনি বিশ্ব নন্দিত মুফাসসিরে কুরআন ছিলেন জানাজাটাও বিশ্বে আলোচনার ঝর বয়ে দিল। লকডাউনের আইন না থাকলে বি,বাড়ীয়া তার অতীতের রেকর্ড ভেঙে একজন আল্লাহর ওলীর চির বিদায় কত সুন্দর ও সম্মানের হয় তা প্রকাশ করত।
আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন আমরা ও ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহ তাআলা আপনার সকল গোনাহ খাতা মাফ করে জান্নাতুল ফেরদাউসের সবোর্চ্চ মর্যাদা দান করুন। আমিন।
