মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি মৃত্যুবরণ করেছেন, না তাকে তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে, চোখ-কান খোলা মানুষের কাছে এ তথ্য অপরিষ্কার নয়। মুরসিকে মেরে ফেলা হলে আজকের বিশ্বরাজনীতিতে সেটা মেরে ফেলা নয়, সাফ করা। যারা আমার সহস্রাব্দের ঋণ বইটি পড়েছেন, তারা পড়েছেন, পশ্চিমা রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির কাছে মুসলিমদের, বিশেষত ইসলামপন্থীদের হত্যা কীভাবে আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে উঠে।


যে মুরসিকে ‘পরিষ্কার’ করা হলো, মিসরের ইতিহাসে ইসলামপন্থী বা ইখওয়ানীদের হত্যা ও বিনাশের ধারাবাহিকতায় এটি নতুন এক সংযোজন মাত্র। মিসরের চরম এক সংকট-মুহূর্তে জন্ম হয় ইখওয়ানের। ইমাম হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে তার অভ্যুদয়।। ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে ইসমাঈলিয়ায় হাসানুল বান্নার বাসায় সমবেত হন তার ছয় বন্ধু। তারা ছিলেন শহরের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাবান, শিক্ষিত সজ্জন। হাসানুল বান্নার বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। নগরীর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হাফিয আবদুল হামীদ, আহমাদ আল হাসরী , ফুয়াদ ইবরাহীম, আবদুর রাহমান হাসবুল্লাহ , ইসমাইল ইজ্জ , যাকী আল মাগরিবী তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। বরাবরের মতো আজও তারা বান্নার সাথে জ্ঞানালাপ ও চিন্তাবিনিময়ে এসেছেন।বান্না তাঁদের সামনে তাঁর চিন্তাধারা পেশ করেন এবং ইসলামী সমাজ বিনিমাণে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন। তারাও চাচ্ছিলেন এমন কিছু। ইতোমধ্যে তাদের চিন্তা-চেতনা এমন কিছুর জন্য তৈরী হয়ে গেচে। হাসানুল বান্নাকে কাজের নেতৃত্ব এবং পথ-নির্দেশনার দায়িত্ব দিলেন, তার হাতে বায়আত করলেন এবং মুসলমানদের রক্ষার জন্য সকল ত্যাগ ও কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হওয়ার প্রয়াসে নিজেদের কুরবান করতে প্রয়াসী হলেন। হাসানুল বান্নার প্রস্তাবে তাদের সংগঠনের নাম হলো ইখওয়ানুল মুসলিমিন। সাতজন মানুষ মিসরের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন এবং মানুষের মুক্তির অভিপ্রায়কে কাঁধে নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন শহরের অলি-গলিতে। বাসায়-বাসায়। ধীরে ধীরে কিছু মানুষ একাত্ম হলো তাদের মিশনে।১৯৩৩ সনে হাসানুল বান্নার আহ্বানে কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় আল ইখওয়ানের প্রথম সাধারণ সম্মেলন। মিসরে তখন খৃস্টান মিশনারীদের ব্যাপক কার্যক্রম। এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিং ফুয়াদকে একটি চিঠির মাধ্যমে খৃস্টান মিশনারীর তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করা হয়। কিং ফুয়াদ একে নিলেন নেতিবাচকভাবে। শুরু হলো ইখওয়ানবিরোধী ষড়যন্ত্র। অপপ্রচার। দমন-জুলুম। সরকারের লেলিয়ে দেয়া লোকেরা সামাজিকভাবে ইখওয়ানীদের হেনস্থা, আক্রমণ ও উপহাসে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে লাগলো। হাসানুল বান্না দমার পাত্র ছিলেন না। তিনি আরো বিপুল উদ্যমে চালিয়ে যেতে লাগলেন দাওয়াতী কাজ। ইখওয়ানের নেতাকর্মীরা দাওয়াতী কাজ বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে করতেন। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে তাঁরা যেতেন, তাদের সাথে মিশতেন, তাদের কথা শুনতেন ও তাদেরকে দ্বীনের কথা শুনাতেন। মাত্র চার বছরের মধ্যেই ইখওয়ান মিসরের একটি গুরুত্ববহ শক্তিতে পরিণত হয়। সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইখওয়ান। স্বতন্ত্র স্কুল-কলেজ, নারী ও বালিকাদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাগার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ইখওয়ানিরা স্বন্ত্র একটি ধারা ও অবস্থান গড়ে তোলেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানাতে থাকেন।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৬ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট ফারুক, প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা নাহাস পাশা এবং আরব বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের কাছে ইখওয়ানের পক্ষ থেকে একটি পুস্তিকা আকারে পত্র দেয়া হয়। পত্রের শিরোনাম ছিল ‘‘আলোর ডাক”। এ পত্রে অত্যন্ত দরদ ও নিষ্ঠাপূর্ণ ভাষায় মুসলিম শাসকদের ইসলামী জীবনব্যবস্থা অবলম্বনের আহবান জানানো হয়। যারা ইসলামকে অবলম্বন করবে, তাদের পক্ষে নিজেদের সর্ব শক্তি বিলিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। ফলাফল হয় উল্টো। আরবশাসকরা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র পাঁকাতে থাকে। ইখওয়ান ততক্ষণে আরব-আফ্রিকার নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শাসকরা স্ব স্ব রাষ্ট্রের ইখওয়ানীদের ধরপাকড়, দমন-নির্যাতন ও নিশ্চিহ্নকরণের চেষ্টা চালাতে লাগলো। নিষ্ঠা, আত্মদান ও ঐকান্তিকতার প্রশিক্ষণ নিয়েই ইখওয়ানকর্মীরা মাঠে নামতেন। ফলে শাসক শক্তির নির্মমতা তাদেরকে আরো তাজা করতো, উদ্দীপ্ত করতো, গতিশীল করতো।

দেখতে দেখতে ইখওয়ান ছড়িয়ে পড়লো বাহ্রাইন, ইরান, ইরাক, ইসরাঈল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, সৌদিআরব, কুয়েত, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, তাজাকিস্তান ইত্যাদি রাষ্ট্রে।

ইখওয়ানের অগ্রযাত্রাকে স্বৈরশাসকেরা বহুবার থামিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বিগত শতকের পন্চাশের দশকে মিসরের ভূখণ্ডে ইখওয়ানের দাওয়াতী কার্যক্রম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ইখওয়ানের সাংগঠনিক শাখা সংখ্যা প্রায় দুই হাজারে উন্নীত হয়। জনশক্তির সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ এ পৌঁছে। ইখওয়ানের অব্যাহত শক্তি বেড়ে যাওয়া দেখে রাষ্ট্রশক্তি ভীত শংকিত হয়ে পড়ে। মাহমুদ ফাহমী আননুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানকে বে আইনী ঘোষণার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র রেখে বলা হলো যে এইগুলো ইখওয়ানের সন্ত্রাসী কাণ্ড। বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তি আততায়ীর হাতে প্রাণ হারায়। সমস্ত দায়ভার চাপানো হয় ইখওয়ানের উপর। ১৯৪৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাত তখন এগারোটায় ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ সংগঠন বলে ঘোষণা করা হলো। দলের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইখওয়ান পরিচালিত স্কুল,কলেজ,ক্লাব,হাসপাতাল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। সারা দেশে একযোগে ইখওয়ানের অগণিত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। জেলখানায় তাদের ওপর চালানো হয় লোমহর্ষক নির্যাতন। সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কাযালয়ে ছুটে এলো। উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করা হলো। হাসানুল বান্না সেখানে ছিলেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি বলতেন, আমাকে গ্রেফতার না করার অর্থ হলো আমাকে তারা হত্যা করতে চায়।

১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় হাসানুল বান্না মিটিং শেষে শুববানুল মুসলেমুনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বের হন। রাস্তায় নেমে তিনি ট্যাক্সীতে উঠতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আততীয় গুলি এসে বিঁধে তাঁর বুকে। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই শায়খ শাহাদাত বরণ করেন। লাশ পাঠানো হয় তাঁর বাসায়। পুলিশ এসে বাড়ির চারদিকে ঘেরাও করে ফেলে। ট্যাংক বাহিনী ও সাঁজোয়া বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহকারে তাঁর লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দূরে অবস্থান করে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। সরকার তাদেরকে তাঁর জানাযা ও দাফন কাজে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি। শায়খ হাসানুল বান্নার পর আবদুল কাদের আওদাহ, যয়নাব আল গাযালি, সাইয়েদ কুতুব ও হামিদা কুতুবসহ অসংখ্য ইসলামী ব্যক্তিত্বকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়।

সাইয়্যেদ কুতুবের সহিত এমন নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে যা অবিশ্বাস্য ঠেকে। জেলখানার কর্মচারীরা কুতুবকে নির্মমভাবে মারপিট করতে থাকে। তাঁর ওপর একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দেয়। কুকুরটি তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে এদিক-ওদিক বেড়াতে থাকে। রক্তাক্ত বেদনায় জর্জরিত শরীর ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না। তারপরেও তিনি ঈমানের বলে বলীয়ান পাহাড়ের মতো অবিচল ছিলেন। এ অবস্থায়ও তাঁর মুখ থেকে উচ্চস্বরে উচ্চারিত হতে থাকত আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। সাইয়্যেদ কুতুব ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তাররা কারগারে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফের অনুরোধে একবার মুক্তি দিয়ে আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতারী পরওয়ানা দেখেই তিনি বলেছিলেন, আমি জানি জালেমরা এবার আমার মাথাই চায়। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। নিজের মৃত্যুর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমার তো বরং সৌভাগ্য যে আল্লাহ্র রাস্তায় আমার জীবনের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। তার ভাই মুহম্মদ কুতুব, ভগ্নি হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশিসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে প্রায় সাতশ’ মহিলা ছিলেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারক জামাল নাসেরের সাথে আলোচনা করে ১৯৬৬ সালের ২১ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় সাইয়্যেদ কুতুব, মুহাম্মদ ইউসুফ, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল, শবরী আরাফাহ, আহমদ আবদুল মজিদ, আব্দুল আজিজ ও আলী উসমাভীর মতো নেতা ও চিন্তানায়কদের। রায় শুনে সায়্যিদ কুতুব হাসতে হাসতে বলেছিলেন আমার কাছে এটা কোন বিষয় নয় যে, আমি কোথায় মরতে যাচ্ছি এবং কিভাবে যালিমরা আমার মৃত্যুদণ্ড দেবে। আমিতো এতেই সন্তুষ্ট যে, আমি আল্লাহর একজন অনুগত বান্দাহ্ হিসেবে শাহাদতের পেয়ালা পান করতে যাচ্ছি।’’ ২৮ আগস্ট রাতে সাইয়্যেদ কুতুব ও তার দুই সাথীকে ফাঁসীর সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৯ আগস্ট ভোর রাতে কার্যকর করা হলো ফাঁসি।

ইখওয়ান এতে মোটেও দমেনি।
১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জামাল আব্দুন নাসেরের শাসনামলে হাজার হাজার ইখওয়ান নেতাকর্মীকে গ্রেফতার নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সাল আনোয়ার সাদাত মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে- চেপে বসা ইসরাইল প্রথম একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। এতে ইখওয়ানের সাথে তার সম্পর্ক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নির্যাতন বেড়ে যায় বহুমাত্রায়। ১৯৮১ সালে এক তরুণ সেনা কর্মকর্তা খালিদ ইস্তাম্বুলি প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৮৪ সালে ক্ষমতায় আসেন হোসনী মুবারক। তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানান। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে মিসরের স্বৈরশাসক হোসনী মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। মিসরের রাজনীতিতে তখন প্রধান ভূমিকায় ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেন মুহাম্মদ মুরসি। মিসরের ইতিহাসের প্রথম সুষ্ঠ ও গণভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন তিনি, যাকে ’পরিষ্কার’ করা হয়েছে গতকাল।

কিন্তু কোনো আবর্জনা আদৌ ছিলেন না তিনি। তার ক্যারিয়ার যে কোন বিশ্বনেতার ক্যারিয়ারের চেয়ে কম উজ্জ্বল ছিলো না। ৮ আগস্ট ১৯৫১ মিসরের আল-শারকিয়ার আল-আদওয়া গ্রামে জন্ম নেয়া মুরসি ছিলেন কৃষকের সন্তান। দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। গৃহিণী মা, পরিবারে আছেন দুই বোন, তিন ভাই, সঙ্কট উজিয়ে চলতে হতো, লড়াইটা হালকা ছিলো না। সংগ্রাম করে করেই নিজেকে নির্মাণ করেন মুরসি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ গ্রামিণ পরিবেশেই । মেধা ছিলো প্রখর, ঔজ্জ্বল্য সেখান থেকেই ছড়াতে থাকে। নেতৃত্বগুণ, মেধার দীপ্তি, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে।

যখন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেন, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন, লাভ করলেন ব্যাচেলর ডিগ্রি । ছাত্রত্ব চালিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ১৯৭৫-৭৬ খ্রিষ্টাব্দে কাজ করলেন মিসর সেনাবাহিনীতে । তখনই ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে গভীর হয় তার সম্পৃক্ততা। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে । নাগরিক সচেতনতায় প্রবুদ্ধ এবং মানবিক কর্তব্যনিষ্ঠায় উদ্দীপ্ত এই মেধাদীপ্ত তরুণ কেবল জ্ঞানপোকা হয়ে মানবিক অপরাপর দায় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পক্ষে ছিলেন না। সমাজ ও রাষ্ট্রে যেসব অন্যায় ও শোষণ জীবনকে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছে, তার কবল থেকে মানুষ ও মানবতার উদ্দারে সদাসচেষ্ট হয়ে উঠেন তিনি। এরই সাথে উচ্চতর জ্ঞানপ্রয়াসে যতি পড়েনি। পিএইচডির জন্য গেলেন সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে,সেখানে লাভ করলেন সেবারের সর্বোচ্চ স্কলারশিপ। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরলেন। কায়রো ইউনিভার্সিটিতে শুরু করলেন শিক্ষকতা। এরপর অধ্যাপনা করেছেন সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমেরিকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, কৃতীত্বের সাথে কাজ করেছেন নাসার মতো প্রতিষ্ঠানে, ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন স্পেস শ্যাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে । ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। একাধারে ২০১০ সাল অবধি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত সুনাম ও মর্যাদার সাথে শিক্ষকতা ও গবেষণাকর্ম অব্যাহত রাখেন। বিজ্ঞানের একান্ত জটিল ও দুরূহ নানা প্রসঙ্গে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধগুলো বিশ্বজোড়ে হয় বরেণ্য । বিজ্ঞান-গবেষণার বিশ্বসেরা জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয় তার শত শত আর্টিকেল।।





সাথে সাথে চলছিলো মানবমুক্তির সংগ্রাম। মিসরের স্বৈরশাসকরা যেখানে বিরুদ্ধমতাবলম্বী মাত্রই হত্যা ও ধ্বংসযোগ্য মনে করেন, সেখানে তিনি জেনে-বুঝেই অগ্নিময় সংগ্রামের কড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিজ্ঞানী, গবেষক কিংবা শিক্ষাবিদ হিসেবে যেখানে তিনি বিশ্বময় বরেণ্য, সেখানে কী প্রয়োজন ছিলো সংগ্রামের এই গণগণে রাজপথে নেমে আসার? প্রয়োজন ছিলো না বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ। কিন্তু মানবিক সমাজ ও পৃথিবী নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মুরসির বিশ্বাস ও আদর্শের নির্দেশে সংগ্রামকে অবলম্বনই ছিলো প্রধান প্রয়োজন। বিশ্বের সবগুলো মতবাদ ও চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানী মুরসি মানবমুক্তির নিশ্চয়তা একমাত্র ইসলামেই খোঁজে পেয়েছিলেন। মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের আকুতিই তার কণ্ঠে তোলে দিয়েছিলো আল্লাহু আকবারের স্লোগান। বৃহত্তর মানবতার সেই মুক্তি ও কল্যাণ হয়ে উঠেছিলো তার যাবতীয় জ্ঞান-প্রজ্ঞার শেষ প্রত্যাশা। একে পুরণের জন্য তিনি নিজের নিশ্চিত সুখ, সমৃদ্ধি, মর্যাদা এবং বিশ্বময় বরেণ্যতা ত্যাগ করে হাঙ্গর-কুমিরে ভরা সাগরে সাঁতার শুরু করলেন নবদ্বীপের সন্ধানে। ইখওয়ানুল মুসলিমিন ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহী হিসেবে হয়ে উঠেছিলো তার প্লাটফর্ম । যৌবনের মধ্যদুপুর থেকে তিনি ইখওয়ানের সংগ্রাম ও সাধনার সাথে নিজেকে যুক্ত করেন নিবিড় ঐকতানে। জ্ঞান ও গবেষণার তুঙ্গে বিচরণসত্তেও নেমে আসেন একেবারে জনতার তৃণমূলে। হয়ে উঠেন মেহনতি শ্রমিক-কিষাণ, কর্মজীবি মানুষের নেতা ও আশ্রয়। ১৯৯৫ ও ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইখওয়ানের পক্ষে লড়েন এবং এমপি হিসেবে ইখওয়ানের পার্লামেন্টারিয়ান দলের নেতৃত্ব দেন। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে তিনি হন সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত এমপি ; অথচ তাঁর পরিবর্তে জয়ী দেখানো হয় তাঁর বিরোধীকে । মিসরীয় পার্লামেন্টে তিনি যখন পা রাখেন, পার্লামেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেন তিনিই।২০০৬ এর ১৮ মে তাঁকে আটক করে সাত মাস জেলে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে তিনি ছাড়া পান। ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি আবারো তাকে জেলে যেতে হয়, প্রতিবাদী জনতাকে সংগঠিত করার দায়ে। তার পরিবার পরিজনের উপর বয়ে যায় নির্মমতার ঝড়। তার স্ত্রী, সাইয়েদাহ নাজলা মাহমুদ,১৯৭৮ বিয়ের পর থেকে যিনি ছিলেন তার সংগ্রাম-সাধনার সহচরী, নির্মমতা তার উপর দিয়েও বয়ে যায়। । মুরসির পাঁচ সন্তান- আহমাদ, শায়মা, উসামাহ, উমার ও আবদুল্লাহ, প্রত্যেকেই রাষ্ট্রিয় প্রতিহিংসায় পিষ্ট হতে থাকেন নানাভাবে।

মুরসি এতে দমেননি মোটেও।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে আরব বসন্তের সংগঠনে রাখেন অন্যতম ভূমিকা। এ জাগরণ মিসরের কায়েমী সরকার ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়। সময়ের নির্দেশে ইখওয়ানকে সামনে রেখে গঠিত হয় সর্বদলীয় মোর্চা ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’, যার ন্যাপথ্য কারিগর ছিলেন মুরসি। এ দলই পরবর্তি নির্বাচনে অর্জন করে বিজয়।

২০১২ সালের নির্বাচনে খায়রাত আশ-শাতেরের পাশাপাশি বিকল্প প্রার্থী মুহাম্মাদ মুরসিকেও প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীতা দেয় ইখওয়ান। শাতেরের প্রার্থীতা বাতিল করা হয়, নির্বাচনে সামনে আসেন মুরসি। আহমাদ শাফিক ও তাঁর মধ্যে হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা।। এতে উভয়ের কেউই ৫০% ভোট পাননি। ফলে দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের ২৪ জুন রবিবার মুরসিকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৫১.৭%। তার বিপরীতে আহমাদ শাফিক পান ৪৮.৩%। ২০১২ সালের ৩০ জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। তিনি মিসরকে সুশাসনের পথে অনেকদূর এগিয়ে নিচ্ছিলেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নারী অধিকার, সামাজিক সাম্য, সম্পদের সুষম বন্টন, ন্যায়বিচার ইত্যাদিতে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি করেন। মুসলিম জাহানের বিরোধজর্জর রাজনীতিতে মধ্যপন্থী সুর উচ্চকিত করেন, মজলুম ফিলিস্তিনীদের পক্ষে উচ্চারণ করেন স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি, গ্রহণ করেন দৃঢ় অবস্থান, অবরুদ্ধ গাজাবাসীর মুক্তির পথে নেন পদক্ষেপ, বিশ্বরাজনীতিতে আপন কণ্ঠস্বরকে করে তুলেন গুরুত্বপূর্ণ , ইরান-সৌদির বিরোধের মধ্যখানে গ্রহণ করেন স্বতন্ত্র অবস্থান, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তৈরী করেন নতুন আশ্বাস।


এটাই ছিলো সমস্যা। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের যে বিন্যাস চায়, রাজনীতির যে ধরণ ও চরিত্র চায়, আমেরিকার নিউ ওয়ার্ল্ড ওর্ডার মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার যে চিত্র আঁকে, মুরসির উত্থানকে তা কোনোভাবেই কবুল করতে পারছিলো না। মুরসি একটি সমস্যা হয়ে উঠছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকান বিন্যাসের পথে। তিনি একটি প্রেরণা হয়ে উঠছিলেন দেশে দেশে স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিরোধী জনতার সামনে। ইসলামী জাগরণকে প্রণোদিত করছিলো তার সাফল্য। ইসরাইল-আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা আরবশাসনের জন্য এ ছিলো একটি খারাপ দিক। একে শেষ করে দেয়া তাদের জন্য জরুরী হয়ে উঠেছিলো। মিসরে তাদের অনুগত ও পোষা লোকদের অভাব ছিলো না। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত পেট্রোডলার ঢেলে দিচ্ছিলো। জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসিকে সামনে আনা হলো। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আপন হাতে ক্ষমতা তোলে নেন। সুপ্রিম সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুরকে অন্তর্বতী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। মোহাম্মদ মুরসিকে গৃহবন্দি করা হয়। ৪ জুলাই তাকে মিশরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ৫ জুলাই অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আদলি ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার পর দেশটিতে ৪১ হাজারেরও বেশি ইখওয়ানীকে গ্রেফতার করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অভিযোগ আনা হয় মুরসি এবং তার ১০৫ সহযোগীর বিরুদ্ধে। তাদের সবাইকে ফাঁসি দেয়ার রায় দেয় মিসরের একটি আদালত ।
(অসমাপ্ত)